টিয়া দেবনাথ
আবুল বাশার
ফরিয়াদি টিয়াটিকে লাল লঙ্কা দেখিয়ে বাবলার ঝুলে থাকা ডাল থেকে গত অঘ্রাণে সন্ধির মাঠে ধরেছিল ধলা চোধ্রিক্ট সেই পাখিটাই এখন রাঙাকাকির লাল রিবন জড়ানো খোঁপায় বসে আছ্বে খোঁপায় জবাকুসুমের গন্ধ৷ পাটকিলে রঙের বেড়ালটা, নাম যার খোখো, সে বারবার তাক করছে৷ খাবে৷ খোখো হাফ-ফ্রি-কে খাবে বলে তাক করছে বুঝি! টিয়ার নাম হাফ্রি (হাফ-ফ্রি) মুকুটি৷
সিঁজদা বিবি কাণ্ড দেখে বলে ওঠেন, ‘ওগো রাঙা বউমা, দেখো দেখো, খোখো কেমন করছে! সাবধান মা! হাফরি রে ঠিক করে খোঁপায় রাখো! পড়ে গেলে খেয়ে নেবে মা!’
– না, না, তাই বললে হয় সিজদা মাসি! হাফ-ফ্রি-র কি শিক্ষে-দীক্ষে নেই নাকি! আচ্ছা, দাঁড়াও দেখাচ্ছি!’ এই বলে রাঙাকাকি তাঁর খোঁপায় বসে থাকা টিয়াকে হাতে ধরে নামিয়ে খোখোর মাথায় দিলেন বসিয়ে৷ আর দেখতে হল না! হাফ্রিকে মাথায় নিয়ে খোখো সারাটা উঠোন গোল হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷
আসলে তো খোখো হাফ্রির সঙ্গে খেলা করার চান্স নেবার জন্যে রাঙাকাকির পিছু পিছু ঘুরঘুর করছিল সেই কখন থেকে! টিয়াকে খেয়ে ফেলবার জন্যে না৷ পেট-ভরা থাকলে খোখো খেলা করতে যায়, কোনও শিকার করার জন্য ছোঁক ছোঁক করে না৷ তাছাড়া বাড়ির জীবের ওপর হামলা করার প্রবৃত্তিই তার নেই৷
– ‘দেখলে তো মাসি!’ বলে একটা হূষ্টভঙ্গি করল কাকি৷ সিজদা চোখ বড় বড় করে খোখোর কাণ্ড দেখতে দেখতে বললেন, ‘ভাল পোষ মানিয়েছ রাঙাবউমা! ধলাকে বলতে হবে৷’
আমার নাম ডাব্লু মুখোটি৷ ধলা আমার সহপাঠী-বন্ধু, দুজনেই ক্লাস এইট৷ ক্লাসের পড়াশোনায় আমাদের তত মন নাই৷ আমাদের যত আগ্রহ পশুপাখির ব্যাপারে আর গাছপালায়৷ তবে কাজের কাজি হচ্ছে ধলা৷ ওর পাখি ধরার নেশা সাঙঘাতিক৷ বিশেষ করে টিয়া৷ টিয়া ধরে আর লোককে পুষতে দেয়৷ সারা তল্লাটে ওর দান করা টিয়াপাখি নানা গেরস্ত বাড়িতে শোভা পায়৷ অন্তত ২২টি গ্রামে ওর দানের টিয়া খাঁচা গুলজার করে রয়েছে৷ টিয়া ধরা এবং দান করার পুরো ব্যাপারে আমিই তার সঙ্গী৷
গল্পটা পুরনো আমলের৷ তখন গ্রামে ছিল সবই প্রায় যৌথ পরিবার৷ কিন্তু ধলা ছিল এক বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান৷ ধলার অবশ্য আরেকটা ডাকনাম আছে৷ বীরুক্ট পশ্চিমপাড়ায় আরেক বীরু আছে বলে, কোন বীরু শুধালে, বলা হয়, ধলা বীরু৷ ও অসম্ভব ফর্সা৷ ওর মা রোগা-পাতলা-সুন্দর দেখতে, তবে এতটুকুনই মানুষক্ট আর ও একটা তাগড়া কিশোর, অনেকে ওকে যুবক মনে করে, আসলে সে তো কতকটা বালক গোছেরই তাগড়াই৷
ওর আসল নাম বীরভদ্র চৌধুরি৷ ওর মায়ের ডাকনাম বিষ্টু চোধ্র্বি আসলে বিষ্ণুপ্রিয়া চৌধুরি৷ ধলার বাবার নাম পবনদূত চৌধুরি৷ এককালে ওরা বড়লোক ছিল৷ কী করে গরিব হয়ে পড়েছে৷ সব যেতে যেতে বিঘা কতক জমি এখনও রয়েছে বিষ্টু মাসির৷
মাঠান জমি তিনখানা প্লটে আছে৷ বোবা বিলের এলাকায় একটা প্লট৷ ডিহির মাঠে একখানা প্লট৷ চকজমার চরে আরও একখানা আছে৷ কিন্তু সবই ছোট ছোট প্লটের জমি, শুধু চরের জমিটা কিছুটা বড়ক্ট বিঘা চারেক৷ কিন্তু সময়টা তখন অন্যরকম্ব তখন জমিতে বর্গা-অপারেশন চলছে৷ রাজশরিকরা জমি ধরে রাখতে পারছে না৷
জমির মূল মালিক, যার লাঙল-বলদ বা ট্রা’র নেই অর্থাৎ নিজে জমি চাষ করতে পারে না, জমি তাকে গরিব বা মাঝারি চাষী, যার লাঙল-বলদ আছে, তাকে ভাগে দিতে হয়্ব মালিক এক্ষেত্রে অল্প জমির মালিক হলেও, তাকে বলা হচ্ছে রাজশরিক আর যে চাষী রাজশরিকের জমি ভাগে নিচ্ছে, সেই ছোট জোতের চাষী হচ্ছে ভাগারু এবং জমি বর্গা করার অধিকারী্ব কারণ স্লোগান হচ্ছে, লাঙল যার জমি তার৷
এইভাবে জোতদারের জমিতে যেমন বর্গা হয়েছে, তেমনি অল্প জমির মালিকেরও জমি জোরকদমে বর্গা হয়েছে৷ জমি বর্গা হওয়ার অর্থ, বর্গাদারেরও জমিতে অধিকার কায়েম হওয়া৷ বিষ্টু চৌধুরির জমিতে বর্গা হল৷ বিষ্টু চাষের সময় বীজ-সারের-সেচের জন্য অর্ধেক খরচা দিতে পারতেন না, ফলে হিসেব দাঁড়ায়, উৎপন্ন ফসলের অংশ বিষ্টু পাবেন, ভাগ নেবে ভাগারু সবকৎ মণ্ডল ওরফে সবকৎ পুড়েক্ট পুড়ে পাড়ায় বাড়ি বলে এই টাইটেল৷
সবকৎ একজন মাঝারি চাষী্ব তার নিজের জমি আছে, বর্গাও আছে, তার পাঁচ ছেলে জমিতে মেহনত দেয় ঢেলে৷ সবকৎ গরিব চাষী থেকে এখন প্রায় মাঝারি চাষীতে উঠেছে৷ বর্গা করার পর সেই জমি সে রাজশরিকের কাছ থেকে কৌশলে কিনে নেয়৷ যে-কৌশলে নেয়, সেই কৌশল গরিব রাজশরিকের ওপর ছাড়া খাটাতে পারে না৷
সেই কৌশল হচ্ছে, ‘ই বচ্ছর ফসলপানি হয় নাই, ভাগের কী দিব তুমাকে বিষ্টু? এই লাও, অধমণী বস্তা জাপান শেখের মাথায় নিয়া আনা গেল, তার বেশি পারা গেল না!’
বিষ্টু অবাক সুরে বললেন, ‘গত বচ্ছরও তো উসমান গাড়ি করে ভাগ দিয়ে গেছে সবকৎ ভাই৷ এ বছর তো ঝরা-খরা কিছুই হয়নি, তা-ও কিনা ধান এল মাথায় করে আধমণ! মনে আছে, গত চৈতালির সময়, সর্ষে বুনলে বাবলার ডিহিতেক্ট সোনা-হলুদ ফুল এসেছে শুনে, গেলাম দেখতে, মনে আছে?’
– ‘আছে বইকি বিষ্টুপিয়া৷ আছে৷’
– ‘তুমি কি বললে ভাই! ফুল দেখছ দেখো, জমিনে পা রাখিও না৷ কারণ রাজশরিক ফসলের ভুঁইতে পা রাখলে ফসলপানি ভাল হয় না! কী অকাট্য সংস্কার ভাই তোমার! শ্রেণীসংগ্রাম থেকে এই সংস্কার এল কিনা, কে বলবে! আচ্ছা ভাই, আমি কি জোতদার?’
– না, না বিষ্টুপিয়া৷ তুমি রাজশরিক, এ যুগে এডাই তুমার পরিচয়!’
– ‘আমি গরিব!’
– ‘হতে পারে!’
আসলে লখাইদিঘি গাঁয়ে একটিও জোতদার ছিল না৷ মাত্র দুজন জোতদার ছিলেন নদীর ওপারে রামপ্রসাদ আর ভূমি মৈত্রক্ট এঁরা ছিলেন ভূস্বামী৷ নদীর এপারে পুড়েপাড়ার আগে বাসনভাঙা গ্রামে জোতদার ছিলেন বটে শিহাব মণ্ডল, কিন্তু তাঁর সন্তানসংখ্যা ধরলে, সেই জোত ভাগ হলে, সন্তানরা হয়ে যায় মধ্যচাষী৷
আমি ডাব্লু মুখোটি (মুকুটি) এই গল্পটা লিখছি ৬৫ বছর বয়েসে৷ আমি লখাইদিঘি জুনিয়র হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলাম৷ এখন থাকি একটি মফস্সল শহরে৷ লখাইদিঘিতে শ্রেণীসংগ্রাম শেষ হয়ে গেছে৷
ধীরে ধীরে সবকৎ পুড়ের একটা নতুন পদবি গজালো আর সেটি হচ্ছে, ভিটেখোর সবকৎ৷ সে কোনও আধা গরিব রাজশরিকের কাছ থেকে জমি ভাগে নেবার সময় থুতনির নুর বা দাড়িতে হাত রেখে খোদার নামে কিরা-কসম করে বলত, ‘আল্লা-কসম ভাই, কিংবা আল্লা-কসম কাকা কিংবা আল্লা-কসম মাসি কি ফুপু, জমি ভাগে লিচ্ছি, তা বুলে ভাবিও না, এই একটা বাঘা জমিতে আমি বর্গা কায়েম করব! তুমার জমি দিদি, হক পয়মাল (স্বত্ব-নাশ) করে লিতে পারব না৷ ধর্মে সইবে না ফুপা!’
ধর্মের নাম করেই হক পয়মাল করত সবকৎ৷ যদিও রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখলে বর্গা-অপারেশনে কোনও স্বত্বনাশের ঘটনাই নয়৷ যার লাঙল নেই, তার জমি থাকবে কেন? রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি কঠিন উগ্রতা ছিল৷ তার থেকে চাষী-মনে জমির স্বত্ব সম্পর্কিত নতুন এক সংস্কারের জন্ম হয়৷ জমিতে মেহনত ঢালছে কে? চাষীর তখন কেবলই মনে হচ্ছিল শ্রম তার আর তার বলদের৷ এক্ষেত্রে ভূমি মৈত্র আর বিষ্ণুপ্রিয়া সমবিন্দুতে রয়েছে৷ ওরা দুজনই চাষীর বিরুদ্ধ পক্ষ৷ এই দুজনই সুতরাং রাজশরিক৷
১৩ কাঠার জমির মালিক এক মুসলিম বিধবাও এক্ষেত্রে রাজশরিক৷ নাম তার ময়না শিকদার৷ মাত্র ওই ১৩ কাঠাই জমি ছিল তার আর তা-ও ছিল ভিটেবাড়ির লাগোয়া৷ সেই জমিতেও বর্গা-রেকর্ড করাল সবকৎ এবং তারপর ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে নিজে হাতে লাঙলের মুঠো ধরে চাষ ফেলল ময়নার উঠোনের গা ঘেঁষেক্ট বৃহৎ অর্থে ওই পুরো ১৩ কাঠাই তো ময়না শিকদারের উঠোন৷ ময়নার উপার্জন হত দু’ভাবে৷ উঠোনে বাঁধা থাকত গাই-বাছুর, ছাগল আর হাঁস-মুরগিক্ট ঘরে পশুপালনে তার আয় আর ওর বাড়িটা ছিল সবজি-বাড়ি৷ সবজির চাষ হত উঠোন আর তার লাগোয়া জমিতে৷ তা থেকে আয় হত৷ ফল-ফকারি-সবজি৷ নিজে হাতে করত ময়না, কেনা লাঙলে চাষ ফেলে ও কোদাল চালিয়ে৷ সেই চাষ গেল৷ সবকৎ ফেলল তার নিজের করা বর্গাচাষ৷ সবকতের বলদ জোড়া ভীষণই তাগড়াই্ব বলদ জোড়ার দিকে সজল চোখে এবং চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল ময়না৷
ভাড়াটে যেমন কালক্রমে বাড়ির মালিক হয়ে যায়, তেমনি বর্গাচাষী হয়ে যায় রাজশরিকের জমির মালিক৷ কারণ, জমিতে বর্গা হলে সেই জমি দায়ে পড়ে বেচতে গেলে কেউ আর কিনতে চায় না৷ তখন রাজশরিক বাধ্য হয়ে সেই জমি বর্গাচাষীর কাছেই জলের দরে বেচে দিতে বাধ্য হয়৷
পবনদূতের এক নিতান্ত গরিব ভাগনি ছিল রমা৷ সে মাঝে মাঝেই বিধবা মামির কাছে এসে লজ্জার মাথা খেয়ে বলত, ‘আমাকে মামু কথা দিয়েছিল বাবলাডিহির আড়াই বিঘা আমাকে দিবে, সেই জমি বেচে আমি যৌতুকের টাকা জোগাড় করব, তারপর বিয়ে করব৷ মামা নাই, তুমি এবার ব্যবস্হা কর মামি৷’
রমা ছিল কিছুটা খ্যাপাটে গোছের নিতান্ত সরল প্রকৃতির মেয়ে৷ তার এই রমা দিদিকে অত্যন্ত ভালবাসত বীরভদ্র৷ বিষ্টুও ভালবাসতেন৷ কিন্তু রমার বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না৷ পাগল মেয়ের বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? এ কথা ভাবতেন৷ ফের ভাবতেন, তত পাগল তো নয় যে, বিয়ে দেওয়া যায় না৷ মাঝে মাঝে তো মনে হয়, রমা বড্ড বুদ্ধি ধরে৷ কিন্তু সারা তল্লাটে রমার মাথার দোষের খবর ছড়িয়ে গেছে কীভাবে কে জানে!
– ‘বিয়ে দিচ্ছ তো মামি!’ বাপের মালকড়ি থাকলে তোমাকে কি আর এত করে কঁকাতে হয়, বল! সবই কপাল বিষ্টু চৌধুরি, সবই কপাল!’ বলে কপালে আলতো করে করাঘাত করত রমা৷
মামি বলতেন, ‘আচ্ছা, হয়েছে!’
– ‘সমস্যা কী জানো মামি?’
– ‘কী?’
– ‘আমি হায়ার ক্লাসে উঠে লেখাপড়া ছাড়লাম, বাপ পড়ার খরচা টানতে পারল না বলে৷ লোকে কী বলে, বলে এই কথা যে, ফরিদার জিন গা বদল করে আমায় ধরেছে, গা-ঘেঁষাঘেষি করতে এই জিনিস ঘটে গেল৷ ভাল কথা৷ ফরিদা আমার সই, সে আমার সজনে ফুল৷ সই বলেছে, ঘোড়া পিরের খাদেম রসুল মিদ্দার পানিপড়া খেলে জিন পালাবার পথ পাবে না৷ তার চেয়ে ভালু, ধানু দেবনাথকে বিয়ে করা৷ বিয়ে করলে এ জিন আপনা থেকেই ছেড়ে পালায়৷ বোঝো৷ সই-ই তো আমার ঘটক মাসি!’
ফরিদাকে একদিন ডেকে পাঠালেন বিষ্টুপ্রিয়া৷
– ‘কী খবর মামি?’ হাসিখুশি ফরিদা, গোলগাল চেহারা৷ দোহারা গড়ন৷ চোখে ফুটে-ওঠা বিস্ময় আর অকারণ খুশির ঢেউ্ব জানতে চাইলে ফরিদা৷
বিষ্ণুপ্রিয়া বললেন, ‘ব্যামো আর নাই?’
– ‘কীসের মামি?’
– ‘জিনের৷ শুনলাম তোমার জিন আমার ভাগনি রমার কাছে গেছে৷ এই জিনটাই কি ধানুকে বিয়ে করতে বলে পীড়া দিচ্ছে ফরিদা? বারবার রমা চাপ দিচ্ছে বাবলার ডিহি বেচে দিতে৷ কিন্তু ময়না শিকদারের অবস্হা তোমার ফুপা সবকৎ পুড়ে কী করে ছাড়লে দেখলে তো! বড়ই উদ্বেগে রয়েছি৷ আমার বেলায় সবকৎ কী করে!’
এই বলে ফরিদার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন বিষ্ণুপ্রিয়া৷ লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলে ফরিদা৷ শুধু একখানা ন’হাতি খাটো শাড়ি পরে এসেছিল ফরিদা৷ খালি পা৷ পায়ের নখ দিয়ে উঠোনের মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বললে, ‘কী তোমাকে বলি মামি! আমার বাবা প্রাইমারির সামান্য মাস্টার৷ জমি যতটুকুনই-যা, ফুপার কাছে ভাগ ছিল, সবই ভাগ-রেকর্ড করিয়েছে, হুদোর মাঠ-খসড়া রেকর্ড হয়ে গেল৷ ফুপা যায় নাই৷ ছোট ছেলে খিজির শেখ গিয়ে যা করার করে এসেছে৷ এদিকে বাবাও তো চাষীবাসীর পক্ষের লোকাল নেতা, বর্গা সাপোর্ট করে৷ আচ্ছা, আমি একন আসি মামি!’
এই বলে মুখ তুলল৷ কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখের দিকে ভাল করে চোখ মেলে চাইতে পারল না৷ তাড়াতাড়ি সে পা বাড়ালে উঠোন ছেড়ে যাবার জন্য৷
পিছন থেকে ডেকে উঠলেন বিষ্ণুপ্রিয়াক্ট ‘দাঁড়াও!’
থমকে দাঁড়াল ফরিদা মুনশি৷ বিষ্ণুপ্রিয়া পিছন থেকে বলে উঠলেন, ‘পাগল হোক৷ ধানুও তো আধা-পাগল৷ পাগলে-পাগলে বিয়ে হবে, তাতে আর বিচিত্র কী! আসলে আমার ভাগনিটা কতকটা একঝোঁকা৷ বিয়ে দিলে জিন ছাড়বে৷ ঠিক আছে৷ শুধাও আড়াই বিঘা উঁচু জমি, ল্যাটা (নিচু) জমি না৷ কত দিবে সবকৎ? কী সংসার মা? পাগলেও যৌতুক চায়৷ যাও৷ ভিটেখোর যেন বিষ্টুর সাথে দেখা করে!’
– ‘হ্যাঁ মামি!’ ঘাড় নেড়ে এ কথা বলে ছুটে পালাল ফরিদা৷
২
বাতাসে হিমের স্তব্ধতা৷ গোকুলপুর-বালুমাটির পুবদিগন্তে ডিমের কুসুমের চেয়ে লাল এবং টাটকা প্রত্যুষের সূর্য শিশিরের ব্যথায় ঝলমল করে জ্বলছে৷ বাবলা ডিহির প্রতিটি বাবলা গাছে বাবলার আশ্চর্য ফুল ফুটে আছে পু? পু? কাঁটাও ঝকমক করছে৷
আমার হাতে ঝুলছে নোটন মালকারের হাতে বানানো বাঁশের তৈরি খাঁচা৷ আমি ধলার থেকে হাতকতক তফাতে পিছনের দিকে আলের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছি৷ আমার পাশে দাঁড়িয়ে রমা দেবনাথ, চাপা উৎকন্ঠা আর ব্যগ্রতায় গাছের একটি ঝুলে থাকা ডালের দিকে চেয়ে আছে, চোখের দৃষ্টি স্হির, পলক পড়ছে না৷
রমা দিদির পেটেবাচ্চা এসেছে৷ তলপেটটা উঁচু-উঁচু দেখাচ্ছে৷ বাচ্চা এসেছে বলে ওর কিন্তু কোনও লজ্জা নেই৷ বরং হালকা একটা গুমোর হয়েছে প্রসন্নতা জড়ানো৷ মাঝে মাঝেই খিলখিল করে অকারণ হাসছে৷
মাঝে মাঝেই নিতান্ত চাপা খাদের গলায় ‘খা-খা’ করে উঠছে৷
– ‘আহ্ আস্তে দিদি৷ কথা বোলো না৷ ফরিয়াদি অত্যন্ত চালাক পাখি, ওদের মধ্যে কে যে লঙ্কায় ভুলবে ভগবান জানে!’ বলে উঠল ধলা৷ তারপর নতুন করে পাখির দিকে মনোযোগ দিলে৷
ওর হাতে একটি নাতিদীর্ঘ পাটকাঠি৷ কাঠির ডগায় যে-ছিদ্র, তাতে লাল লঙ্কার বোঁটা সাঁধ করে নেওয়া হয়েছে৷ অন্য লালে টিয়া ভোলে না৷ আসলে লঙ্কাটা খাবে বলে লালিমা দেখে ওপরের ডাল থেকে নিচের ডালে নেমে আসে৷ লোভ দেখাতে দেখাতে লঙ্কাটাকে অত্যন্ত ধীরে টেনে নিতে হয়– একটুখানি টেনে লোভাতে হয়৷ এক পা নেমে দেড় পা পিছনের ‘কেতা’ দেখায় ফরিয়াদি৷ কী আশ্চর্য! বাবলার কাঁটায় একবারও খোঁচা খায় না৷ বাবলার ফুল খায়৷
বাবলার এই ডিহি আশ্চর্য সুন্দর জায়গা৷ পাশেই নদী গোমোহনী৷ নদীর গা-লাগা একটা বড় পুকুর৷ নদীর ওপর দাঁড়া বা সাঁকোক্ট বাঁশের সাঁকো নয়৷ পাকা সাঁকো৷ তার ওপর দিয়ে পথ৷ সাঁকো পেরিয়েই পুকুরটা পড়ে৷ তার উত্তর-পুবে বেশ উঁচু প্লটে এই ডিহি৷ আড়াই বিঘা জমির আল ধরে বাবলা গাছের সারি৷ এখান থেকেই বেশির ভাগ টিয়া পাকড়াও করে ধলা৷ ঝাঁক ঝাঁক টিয়া এসে ঝটাপটি লাগায়ক্ট সে এক আশ্চর্য দৃশ্য!
এই আড়াই বিঘায় একটি খিরিশ ও কদম গাছ আছে আর আছে কয়েকটা ডুমুর গাছ এবং পেয়ারা গাছও আছে৷ বাবলায় সচরাচর অন্য পাখিরা বসে না৷ অন্যরা বাবলা বাদে অন্য গাছগুলোয় বসে এই শীতে ফেস্টিভ্যাল করে৷ বাবলার ফুল খেয়ে বারমেসে পেয়ারাগাছে পেয়ারা খেয়ে টিয়াগুলো কত যে কেরদানি করে, তার ইয়ত্তা নেই৷ কিন্তু পেয়ারা না পাকলে মচ্ছব শুধু বাবলা গাছকে ঘিরে চালিয়ে যায়ক্ট সেই বাবলা ফুল ও কাঁটার ভেতর থেকে একটা ফরিয়াদী টিয়াকে নামিয়ে এনে খাঁচায় ঢোকানো, তা-ও একটা লাল লঙ্কা দেখিয়ে, কম কথা নয়৷ এর জন্য যে ধৈর্য দরকার, যে স্হির দৃষ্টির মগ্নতা দরকার, তা ক’টা বালক বা কিশোরের থাকে!
সেই পাখি ধরে লোককে পুষতে দেয় ধলাক্ট ওই পাখির সুবাদে ২২ গ্রামে লোকের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে বীরভদ্র ওরফে ধলার৷
কিন্তু আজকের গল্পটা অন্য রকম৷ রমা এখন গর্ভবর্তী, সে একটা টিয়া নেবে বলে এসেছে৷ তাই মাত্র একটা টিয়া ধরতে পারলেই হল৷ টান৷ আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় সফল হল ধলা, কিন্তু আঙুলে কাঁটার খোঁচা খেয়ে আঙুল থেকে রক্ত ঝরতে লাগল বীরু ওরফে বীরভদ্র ওরফে ধলার৷
– ‘ভাই! গলগল করে রক্ত পড়ছে রে? বলে উঠল সকাতরে রমা৷ সে তার আঁচল ছিঁড়ে টুকরো কাপড়, যা ন্যাকড়ায় পর্যবসিত হয়েছে, তাই দিয়ে কচুর ডগার রস বার করে আঙুলে মাখিয়ে জড়িয়ে বেঁধে দিলে তাড়াতাড়ি করে৷ আমার হাতের ধরা ছিল পাখিটা৷ সেটাকে খাঁচায় ঢোকালে ধলা৷ খিল আঁটলে৷ তারপর রমা দিদির হাতে বীরভদ্র সেই টিয়াবন্দী খাঁচাটা ধরিয়ে দিয়ে বললেক্ট ‘চলো!’
– ‘অ্যাই দাঁড়া! কোথায় যাবি! ফরিয়াদী ধরে লোককে দিয়ে কুটুমতালি (আত্মীয়তা) চলবে না৷ দাঁড়া বুলছি, দাঁড়া! তুমিও দাঁড়াও রমা৷ অ্যাই ডাব্লু তুইও দাঁড়া!’
বলতে বলতে এগিয়ে এল তৈমুর পুড়ে, সবকতের ৪ নম্বর ছেলেটা – যার জীবনের প্রধান লক্ষ্য একটি লাল টুকটুকে ট্রা’র কিনে জোত করা৷
হিয়াতুল্লা ওরফে হিয়া জোতদারের মতো একখানি লাল টুকটুকে ট্রা’রের স্বপ্ন নিয়ে সবুজ টিয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তৈমুর পুড়ে৷ সে একেবারে রমার কাছে এসে দাঁড়াল৷ তার চোখে-মুখে ব্যঙ্গের নিঃশব্দ হাসি দেখা দিল৷
তৈমুর আমাকে বলল, ‘দে ডাব্লু খাঁচার পাল্লা খুলে দে৷ আর তুমি রমা দেবনাথ খাঁচায় হাত ঢুকেয়ে ফরিয়াদীকে ধরবা৷ শুনলা? টিয়ারে ধরবা৷ তারপর আসমানে উড়ায়ে দিবা৷ এই পাখি, এই ডিহি, সবই এখন ডিহিদার সবকতের জিম্মায় দাখিল করেছেন খুদা৷ এই খতেন আর বিষ্টুপিয়ার নাই রে পাগলী! দে উড়ায়ে দে৷ ই খানে পাখি ধরতে এলে ধলা তোর পা ভেঙে খুড়া করে দিব৷ এই পাখি, এই চরাচর আমার৷ দেখ৷ তাকা৷ সব আমার বাপের৷ পুড়ে মহাশয়ের খতেন৷ দাও, রমা উড়ায়ে দেও!’
রমার চোখমুখ কেমন ম্লান হয়ে গেল৷
সে ফরিয়াদী টিয়াকে খাঁচা থেকে টেনে বার করে নিয়ে বাতাসের শূন্যতায় মাথার উপরে ছুঁড়ে দিয়ে চাপা একটা আর্তনাদ করে পেটে দু’হাত চেপে আলের উপর বসে পড়ল, মুখে অস্ফুট-অর্ধস্ফুট শব্দ বার হল, ‘হা ভগবান!’
তারপর সাথে-সাথে রমা বলে উঠল, ‘পাখি ছুঁড়লাম বাতাসে আর অমনি লাফিয়ে উঠল পেটের বাচ্ছাটা৷ এখনও লাফাচ্ছে ভাই! দেক, ঘাই মারছে রে ধলা! তুই আর কী করবি! পুড়ে মশাই ডিহিদার, কী করবি আর!’
তারপর রমা বলল ভাইয়ের হাত ধরে, ‘ভাবিস না ভাই৷ আমার মেয়ে হবে৷ তার নাম রাখব টিয়া দেবনাথ৷ এখন বাড়ি চ৷ খাঁচাটা ফেলে দে ডাব্লু!’
পা বাড়িয়ে পিছনে একবার ফিরে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল ধলা৷ তার চোখ আশ্চর্য জলে ঝাপসা হয়ে এল৷ এই পাখি, এই চরাচর আর তার রইল না৷
শুধু এই সময় একটি বেড়াল মাথায় একটি টিয়া নিয়ে সারা উঠোন ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ থামছে না৷
শনিবারের চিঠি/ আটলান্টা/ ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬
বাংলাদেশ সময়: ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৯ জানুয়ারি ২০১৬
https://thesaturdaynews.com | Sikder Rahman
Development by: webnewsdesign.com