লেখকঃ ইব্রাহীম চৌধুরি
বাইরে ঝলমলে রোদ। চমৎকার আবহাওয়া। চারপাশে চেরি ফুলের সমারোহ। এমন সময় ‘মহামারি করোনা: ডেটলাইন নিউইয়র্ক’ বইটি হাতে পেয়ে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল।
আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়তে শুরু করলাম। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ছি আর দেখছি, এ যেন করোনা মহামারি কালের দলিল। করোনার কারণে যে দুঃসহ সময়টা আমরা অতিক্রম করে এসেছি, সেই অন্ধকার সময়টাকে, বিপন্ন মানুষের আহাজারি, করোনায় আক্রান্ত পরিচিতজনের বেঁচে থাকার আকুতি, মুহুর্মুহু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ, মৃত্যুর মিছিল, চোখের সামনে একের পর এক প্রিয়জনের পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া, সেই সময়টাকে বইয়ের মলাটে বন্দী করেছেন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো বইটিতে তিনি শুধু অভিজ্ঞতার কথাই লেখেননি, সে সময় যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে ছিলেন আছে তাঁদের কথাও। সামনের সারি থেকে যেসব যোদ্ধা শ্রম দিয়েছেন তাঁদের কথাও একের পর এক এসেছে বইটিতে। বইটি পড়ছিলাম আর চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছিল সময়টা।
চীনের উহান থেকে করোনার থাবা শুরু হলেও করোনায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় নেমে এসেছিল নিউইয়র্কে। যে নগর ঘুমায় না বলা হয়, সেখানেই স্থবির হয়েছিল জীবনের চলার পথ। সে সময় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল নিউইয়র্কে। থমকে গিয়েছিল নিউইয়র্কবাসী। নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো থেকে শুরু করে মেয়র বিল ডি
ব্লাজিও কী করেছিলেন তা লিপিবদ্ধ হয়েছে এই বইয়ে।
সে সময়টা অর্থাৎ সেই মার্চ থেকে শুরু করে মে পর্যন্ত প্রথম দিকের দিন তারিখ ও মাস উল্লেখ করা হয়েছে বইয়ে। পড়তে পড়তে এক সময় মনে হলো, আমরা হয়তো থাকব না, কিন্তু এই বইটি থেকে যাবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। আমরা হয়তো ভুলে যাব পেছনে ফেলে আসা সেই দুঃসময়। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে থেকে যাবে করোনা কালের এ এক ঐতিহাসিক দলিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন পড়বে এই বই, তখন জানবে সেই কঠিন বাস্তবতার পথ পাড়ি দিয়ে কী ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে মানুষের জীবন। জানবে, দেয়ালের ওপাশে থাকা পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথা বলার তিক্ত অভিজ্ঞতা। চাইলেই ছুতে পারছে না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কীভাবে ধরে রাখার চেষ্টা আপনজনকে। তবুও অনেকে পারেনি। এই যে হাহাকার, বেদনা তা ছিল এক একটি পরিবারের জন্য দুর্বিষহ যন্ত্রণার করুন রূপ। তা উঠে এসেছে এই বইয়ে। সেই সময়টাকে বইয়ে ধারণ করেছেন লেখক ইব্রাহীম চৌধুরী। মানুষ কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এই দুঃসময়ে, কীভাবে মনের গহিনের যন্ত্রণা চাপা দিয়ে পথ চলেছে তা লেখক নিজে লিখেছেন এবং তুলে ধরেছেন অন্য লেখকদের লেখা, অভিজ্ঞতা ও কর্মকাণ্ড। করোনার দুঃসময়ে এগিয়ে আসা মানুষের কথাও লিপিবদ্ধ রয়েছে বইয়ে।
করোনা মহামারি আমাদের সময়ের এক দুঃসহ ইতিহাস বলা চলে। আজ থেকে শত শত বছর পরেও এ নিয়ে কথা হবে, গল্প হবে। এই করোনার কারণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে লাখো মানুষ, আর আক্রান্ত হয়েছে কোটি কোটি। আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে প্রিয়জন। যে ক্ষত বুকের গভীরে থেকে যাবে। এই বইয়ে আছে মানুষের আর্তনাদের কথা, খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা, কীভাবে শোকে পাথর হয়েছেন সেই অভিজ্ঞতার কথা, কীভাবে একে অপরের পাশে ছিলেন সেই কথা। নানাজনের, নানা লেখকের সংগঠনের ধারণ করা মূল্যবান ছবি সব আছে এই বইয়ে। আমার মতো একজন সামান্য লেখকের লেখাও লিপিবিদ্ধ হয়েছে এই বইয়ে।
সময় চলে যাচ্ছে, আজ যা বর্তমান কাল তা অতীত। সময়ের এই আবর্তনে আমরাও হারিয়ে যাব একদিন। কিন্তু থেকে যাবে এই অসাধারণ বইটি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ঘরবন্দী মানুষ ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীরা, গবেষকেরা টিকা আবিষ্কার করে করোনা থেকে লড়াই করে বাঁচার পথটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছি। কিন্তু করোনার কারণে যে দুঃসহ সময়টা আমরা অতিক্রম করে এসেছি, সেই সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকবে মহামারি করোনা ডেটলাইন নিউইয়র্ক এই বই।
বাংলাদেশ সময়: ৫:২২ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৫ জুন ২০২১
https://thesaturdaynews.com | Sikder Rahman
Development by: webnewsdesign.com